মনের অবস্থা, স্থিতপ্রজ্ঞ ও ব্রাহ্মীস্থিতিঃ
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।।
অর্থাৎ, দুঃখ উপস্থিত হলেও যার মন উদ্ধিগ্ন হয় না, সুখ উপস্থিত হলেও যার একটুও স্পৃহা উৎপন্ন হয় না।যিনি রাগ, ক্রোধ ও ভয় থেকে মুক্ত তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
স্থিতপ্রজ্ঞ মহাপুরুষ তো সেই হয়,যার মন একদম স্থির ও শান্ত থাকে। এই মনের স্থিরতার ফলে মানুষ পরমানন্দ অনুভব করে। কিন্তু মানুষের মন বায়ুর ন্যায় সদা চঞ্চল।এই মন কিছুক্ষণের জন্য একটা বিষয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার পর, পরক্ষণেই আবার অন্য বস্তুর দিকে ধাবিত হয়।বস্তুত মনের এই অস্থিরতার কারণেই, মানুষ সুখ-দুঃখ ও সদা তৃষ্ণা অনুভব করে।যার ফলে মানুষ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাই এই অস্থির মনকে বশিভূত করা আবশ্যক।
আত্মার সারথি যেমন এই দেহ, তেমনি এই মন দেহের সারথি স্বরূপ। এই মন'ই তো দেহ ও দেহে অবস্থিত ইন্দ্রিয় সকলকে পরিচালিত করে।তাইতো গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, মনকে ইন্দ্রিয় সকলের শ্রেষ্ঠ বলেছেন। এই মন দেহে অবস্থিত থেকেও অদৃশ্য, কিন্তু দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করে থাকে। এই মনের সাহায্যেই তো মানুষ জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হয়ে থাকে।
কিন্তু, দুঃখের বিষয় এই যে,এই মন জীবদের মায়া ও মোহের অন্ধকারে সদা নিমজ্জিত করে রাখে।জীবদের অজ্ঞানতার কারণে মৃত্যু অবধি এই মন নানা দিকে ধাবিত করতে থাকে।কিন্তু, যিনি জ্ঞানী তিনি অবশ্যই মনকে নিজের অধীনে রাখার চেষ্টা করে।এইরকম মহাত্মারা নিজের মন দ্বারা হৃদয়ে অবস্থিত সেই আত্মা ও আত্মার মধ্যে সেই পরমাত্মার প্রত্যক্ষ দর্শন করে থাকেন।
মানুষের মন নিয়ন্ত্রণে না থাকার ফলে, মন সবসময় ইন্দ্রিয় আসক্তিতে মত্তে থাকে।যার ফলস্বরূপ মানুষ জড় বিষয়ের প্রতি সদা আকর্ষিত থাকে।কিন্তু, যার মন নিজ আত্মাতে একদম স্থির হয়ে গিয়েছে,সে মন জীবাত্মার আদেশ পালন করা শুরু করে দেয়।তখন তার কাছে ভোগ্য জড় বিষয়সমূহ বিষস্বরূপ মনে হয়।এই বিষয়ের প্রতি বৈরাগী মন'ই তাকে একসময় পরমাত্মার চরণে নিয়ে যায়।এর অর্থ এই যে-"মনের অধীনে নিজেকে রাখলে এই মন মায়া-মোহের অন্ধকারে মানুষকে ডুবিয়ে রাখবে, যদি এই মনকে নিজের অধীনে রাখা যায়,তবে এই মন মানুষকে মোক্ষের দরজায় নিয়ে যাবে।"
মনকে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন,
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্।
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেণ চ গৃহ্যতে।।
অর্থাৎ, হে মহাবাহো! মন যে দূর্দমনীয় ও চঞ্চল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু হে কৌন্তেয়, ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশ করা যায়।[৬/৩৫]
অভ্যাস অর্থাৎ, নিরন্তর অভ্যাস।মন এইদিক ঐদিক ঘুরাঘুরি সত্ত্বেও বারবার নিজের আত্মাতে স্থির করতে হবে।যেমন, একটি পাগলা ঘোড়া এইদিক -ঐদিক ছোটাছুটি করে, তেমনিও মন পাগলা ঘোড়ার মতো এইদিক-ঐদিকে ঘুরাঘুরি করে।কিন্তু, কোনো মানুষ যখন ঐ পাগলা ঘোড়ার পিঠে উঠতে চাইলে, প্রথমে মানুষটিকে বারবার আঘাত পেতে হবে।যদি মানুষটি নিষ্ঠাবান হয়, তবে একসময় আঘাত পেতে পেতে মানুষটি ঘোড়ার পিঠে আসীন হয়ে যাবে।একবার পিঠের উপর আসীন হতে পারলেই, ঘোড়াটি তখন চালকের নিয়ন্ত্রণের রশির কারণে চালকের আজ্ঞা পালন করা শুরু করবে।তেমনি মনকে একবার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই, সে মন আপনাতেই জীবাত্মার আদেশ পালন করা শুরু করবে।কিন্তু, অনেক সময় মন নিয়ন্ত্রণে আসার পরও, ইন্দ্রিয়সকলের বিষয়াসক্তির কারণে মন আবার ভূল পথে চলে যেতে পারে।
তাই মনকে বারবার স্মরণ করানো উচিত যে, এই ভোগ,কাম,লালসা সব মিথ্যা।তখন, মানুষের মধ্য থেকে এইসব বিষয়ের প্রতি মোহ নষ্ট হয়ে, বৈরাগ্য উৎপন্ন হবে।আর তখনিই মানুষ মন থেকে সন্ন্যাসী হয়ে উঠে। তখন সেই মহাত্মার মন আত্মনিষ্ঠ হয়ে আত্মাতে স্থির হয়ে যায়।এই আত্মনিষ্ঠার ফলে যোগীর মনে তখন বাসনার লেশমাত্র থাকে না। ফলে যোগীর মনে থাকা সমস্ত কামনা একেবারে মরে যায়।তখন সেই যোগীর মন নিরাসক্ত হয়ে যায়। যার ফলে যোগীর বুদ্ধিও স্থির হয়ে যায়। দর্শন, শ্রবণ,স্পর্শ, ঘ্রাণ, ভোজন,গমন, নিদ্রা ও নিশ্বাস আদি ক্রিয়া করেও সেই যোগী ব্যক্তি জানেন যে,তিনি কিছুই করছেন না।কারণ জড় ইন্দ্রিয়গুলিই কেবল ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে প্রবৃত্ত হচ্ছে। এইরকম মহাপুরুষ ইন্দ্রিয়সকলকে নিরাসক্ত হয়েই উপভোগ করে।এইরকম যোগীদের শাস্ত্র 'নরোত্তম' বলে সম্বোধন করে।
এইরকম স্থিতপ্রজ্ঞতাকে নিষ্কাম কর্মযোগের চরম অবস্থা বুঝায়।এইরকম পুরুষ সমবুদ্ধি অর্থাৎ জয়-পরাজয়, লাভ-হানীর কথা না ভেবে যোগ দ্বারা পরমাত্মায় আস্থা রেখে কাজ করে যায়,একে সমত্বযোগও বলা হয়ে থাকে।সেই মহাপুরুষ জানেন যে, সৃষ্টিকর্তা তার সাথে সবসময় রয়েছেন। তাই তিনি সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় পান না।এইরকম মহাত্মা, না সুখের সময় অতিরিক্ত খুশী হন,না দুঃখে অতিরিক্ত শোক করেন! এইসব মহাত্মাদের ইন্দ্রিয় সকল কচ্ছপের অঙ্গ সমূহের ন্যায় সর্বদা সঙ্কুচিত থাকে।কারণ, ইন্দ্রিয় সকলের বাসনা এতটাই প্রবল থাকে যে,একজন স্থির মানুষের প্রজ্ঞাও হরণ করে নিতে পারে।তাই স্থিতপ্রজ্ঞ মহাপুরুষেরা সবসময় বিষ সমান বিষয়সমূহকে নিগ্রহ করে চলে।কারণ, তাদের কাছে এইসব বিষয়সমূহ রাত্রিস্বরূপ মনে হয়।বায়ুরহিত স্থানে যেমন প্রদীপ স্থির থাকে,তেমনি স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির প্রজ্ঞাও সেইরূপ স্থির থাকে।যার কারণে, এইসব বিষয়সমূহ এইরকম স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির সামনেও যদি থাকে, তাকে সেইসব আকর্ষণ করতে পারে না।যেমনটা নদীর পানি সাগরে এসে বিলীন হয়ে যায়, তেমনি স্থিতপ্রজ্ঞ মহাপুরুষের প্রজ্ঞার সামনে বিষয়সমূহ বিলীন হয়ে যায়।এইরূপ স্থিরপুরুষ সম্পূর্ণরূপে কামনারহিত ও আত্মমননের ফলে, তার চিত্ত ব্রহ্মে নিরন্তর বিচরণ করতে থাকে।এইরূপ নিত্য মননের ফলে স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির মন সর্বদা ব্রহ্মে অবস্থান করে।চিত্তের এইরূপ স্থিতিকেই ব্রাহ্মীস্থিতি বলে,এই অবস্থা'ই হচ্ছে জীবাত্মার মুক্তির অবস্থা।
অনেক বড় বড় সাধু পুরুষও সৃষ্টিকর্তার কৃপা ব্যতীত এইরকম মানসিক স্তরে উন্নীত হতে পারে না।তাই সর্বদা অনাসক্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তায় আস্থা রেখে নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান করুন।কারণ, নিষ্কাম কর্মই সহজে আপনাকে স্থির করতে সাহায্য
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন